গত ১৮ অক্টোবর সকাল ১০:৩০ টায় খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলাধীন ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে জাবারাং কল্যাণ সমিতি ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এর সহযোগিতায় মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম এর আয়োজনে ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সাথে এক ফলোআপ মিটিং আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি রেণুকা চাকমা।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ত্রিশুল চাকমা, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা সবিতা চাকমা, বংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এর ফিল্ড প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাজেশ অধিকারী, জাবারাং এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর বিনোদন ত্রিপুরা, প্রকল্প সমন্বয়ক জয় প্রকাশ ত্রিপুরা, দামপেদা কার্বারী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জীবন স্মৃতি তালুকদার, জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সদস মো: মনচুর আলম, অংচিংমং মারমা, জেলা স্বাস্থ্য অধিকার যুব ফোরাম সদস্য খলেন জ্যোতি ত্রিপুরা, ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ।
সভার শুরুতেই পরিচয়পর্ব শেষে সভার সঞ্চালক জাবারাং কল্যাণ সমিতির কর্মসূচি সমন্বয়কারী বিনোদন ত্রিপুরা ফলোআপ সভার উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেন। তিনি শুরুতে গত ৩ আগস্ট ২০২৩ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় নবগঠিত কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির সকল সদস্যকে শুভেচ্ছা জানান। এরপর তিনি গত সভায় আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী বিশেষত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে যাতায়াতের রাস্তা দ্রুত সংস্কার এবং সেবাগ্রহীতাদের সুবিধার্থে ফ্যান ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র প্রদানের জন্য ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মহোদয়ের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি, কেন্দ্রে ডেলিভারি করানোর জন্য স্থানীয় এলাকাবাসীদের উদ্বুদ্ধ করা, কেন্দ্রে রাত্রিকালীন নিয়মিত ডিউটি ও জরুরী প্রয়োজনে স্ট্যান্ডবাই এ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা ইত্যাদি বিষয় ফলোআপ-এর কথা সভার শুরুতে উপস্থাপন করেন এবং এই কেন্দ্র ভালভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য উপস্থিত সকলের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি ক্যায়াংঘাট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সুন্দর পরিপাটি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ পর্যবেক্ষন করে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ প্রতিনিধির সন্তুষ্টির কথাও তুলে ধরেন।
স্বাগত বক্তব্যে ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ত্রিশুল চাকমা ফলোআপ মিটিং আয়োজনের জন্য স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম, বাংলাদেশ হেল্থ ওয়াচ ও জাবারাং কল্যাণ সমিতিকে ধন্যবাদ জানান এবং স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। তিনি জানান প্রতি ২ মাস অন্তর অন্তর ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিং করার বিধান থাকলে সেটি করা সম্ভব হয় না। মিটিং এ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি কম থাকে। তাই এ বিষয়ে তিনি জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন। স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিক স্টাফ না থাকায়, বিশেষ করে রাতের বেলায় কোন স্টাফ না থাকায় প্রসূতি মায়েরা সেবা নিতে আসে না বলেও তিনি মন্তব্য প্রকাশ করেন। তিনি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত চেয়ার ও আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করার জন্য, দ্রুত রাস্তা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহনের জন্য উপস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ করেন। এছাড়াও তিনি জানান স্বাস্থ্য কেন্দ্রের Paid Peer Volunteer (PPV) গন বিগত প্রায় ৫ (পাঁচ মাস) যাবত বেতন পাচ্ছেন না। তাছাড়া PPV-দের উঠোন বৈঠক করার জন্যেও কোন চা নাস্তা খরচ দেওয়া হয় না। তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উর্ধোতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য তিনি বাংলাদেশ হেল্থ ওয়াচ প্রতিনিধিকে অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ হেল্থ ওয়াচ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাজেশ অধিকারী বলেন, এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রকে এগিয়ে নেওয়া গেলে এলাকার মানুষের অর্থের সাশ্রয় হবে, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হবে। এই সেবাকেন্দ্রে নিয়মিত ডাক্তার থাকলে রোগীরাও সবসময় চিকিৎসা নিতে আসবে। তাই কেন্দ্রের উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সক্রিয়তা খুবই জরুরী।
তিনি আরও বলেন, কমিটির কাজ হচ্ছে চৌকিদারির কাজ। কেন্দ্র পরিচালনায় কোথায় কি সমস্যা রয়েছে, কেন্দ্রে রোগী না আসার কি কি কারন রয়েছে, সেগুলো খুুঁজে বের করে সমাধানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। সন্তান জন্মগ্রহনের পূর্ব ও পরবর্তী চেক আপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে, শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যু হার কমানোর বিষয়ে নিয়মিতভাবে সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক করতে হবে। কৈশোর বান্ধব সাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবাসমূহ সম্পর্কে এলাকার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জানানোর উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। প্রয়োজনে সচেতনতামূলক বিভিন্ন সভা, উঠান বৈঠক করার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ প্রদান করবে। সচেতনতামূলক সভার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সহযোগিতায় গ্রামে মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজনেরও প্রস্তাবনা রাখেন তিনি।
পরিশেষে তিনি মহালছড়ি উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় অত্র ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র সভাপতি মহোদয়ের মাধ্যমে ক্যায়াংঘাট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে অনতি বিলম্বে ডেলিভারির সকল ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক মর্মে জোর দাবী জানানোর আহবান জানান।
ক্যায়াংঘাট ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মহেন্দ্র চাকমা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত রাস্তা সংস্কার ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দেন। তিনি আরও বলেন এলাকার গর্ভবতী মায়েরা টাকার বিনিময়ে হলেও পাশর্^বর্তী সূর্যের হাসি ক্লিনিকে সেবা নিতে চলে যায়, কেননা সেখানে সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও নার্সরা থাকেন। তাই এলাকার গর্ভবতী মায়েদের ক্যায়াংঘাট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রমূখী করতে হলে এখানে ডেলিভারির সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিতভাবে নার্স ও ডাক্তারদের থাকতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক সবিতা চাকমা বলেন যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার জন্য এলাকার মানুষজন এখানে চিকিৎসা নিতে আসে না। বিভিন্ন রোগের জন্য গ্রামের মানুষজন এখনো গ্রামের বৈদ্য বা কবিরাজের উপরই বেশি নির্ভরশীল বলে তিনি মন্তব্য করেন। এখানকার সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে পাহাড়ীদের তুলনায় গুচ্ছগ্রামের বাঙালীদের সংখ্যায় বেশি বলে তিনি জানান।
দামপেদা কার্বারী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জীবন স্মৃতি তালুকদার বলেন, আমাদের সনাতনী ধ্যান ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। চিকিৎসা সংক্রান্ত, নারীদের মাসিক সংক্রান্ত প্রচলিত বিভিন্ন ট্যাবু-কুসংস্কার দূর করতে হবে। শিশু মৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার শূণ্যের কোটায় আনতে হবে। বাল্য বিবাহের ক্ষতিকর দিকসমূহ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নের জন্য ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি জোর দিয়ে বলেন এবং সকলের প্রচেষ্টায় অবশ্যই ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, এই ক্যায়াংঘাট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রকে সকলের প্রচেষ্টায় মডেল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে এটি দেখে অন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়। এজন্য কমিটির সক্রিয়তা ও কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই কেন্দ্রের সমস্যাসমূহ দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এই কেন্দ্রের সেবাসমূহ সম্পর্কে জনগনকে জানাতে ও সচেতন করতে ফ্যামিলি প্ল্যানিং কার্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অধিকতর সক্রিয় থাকার অনুরোধ জানান তিনি। পাশাপাশি জরুরী প্রয়োজনের সরকারি হেল্পলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিতের বিষয়েও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
ফলোআপ মিটিং-এ মোট ২৫ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন (নারী-১২ জন, পুরুষ-১৩ জন)। সভাশেষে উপস্থিত ক্যায়াংঘাট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ব্যবস্থাপন কমিটির সদস্য এবং পার্শবর্তী কায়াংঘাট হাই স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাস্থ্য অধিকার বার্তা ও ঋতু কমিক বই বিতরণ করা হয়।
প্রতিবেদক: জয় প্রকাশ ত্রিপুরা,কো-ফোকাল, স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম, জাবারাং কল্যাণ সমিতি, খাগড়াছড়ি।
Citizen's Voice