মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম ও মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য অধিকার যুব ফোরামের উদ্যোগে জাবারাং কল্যাণ সমিতি ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের সহযোগিতায় ১৯ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি. সকাল ১১:৩০ টায় মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে আমাদের করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সভাপতি জনাব মো: শাহজাহান পাটোয়ারী'র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মেডিকেল অফিসার ডা: কলিন্স চাকমা। স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম, খাগড়াছড়ি'র ফোকাল পয়েন্ট এবং জাবারাং কল্যাণ সমিতি’র কর্মসূচি সমন্বয়কারী বিনোদন ত্রিপুরা'র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ'র প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাজেশ অধিকারী, স্বাস্থ্য পরিদর্শক বিবেকাময় ত্রিপুরা, পরিসংখ্যানবিদ লুনা চাকমা, হার্বাল এসিস্ট্যান্ট ভবতোষ দেওয়ান, মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সদস্য হেডম্যান স্বদেশ প্রীতি চাকমা, সদস্য ভৌমিকা ত্রিপুরাসহ যুব ফোরামের সদস্য, সংবাদকর্মী ও সেবাগ্রহণকারীদের প্রতিনিধি।
সভার শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাজেশ অধিকারী। তিনি বলেন, মহালছড়ি উপজেলা হেলথ্ কমপ্লেক্স এই উপজেলার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি এই উপজেলার ৫০-৫৫ হাজার মানুষের প্রতিষ্ঠান। কেননা এই উপজেলার মানুষজনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের বিষয়টি এই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপরেই নির্ভরশীল অনেকাংশে। দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে একটি চেইন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মহালছড়িকে বাদ দিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আগানো যাবে না। তাই দেশের সামগ্রিক চিকিৎসাসেবার মানকে উন্নত করতে হলে মহালছড়ির সাস্থ্যসেবার মানকে অবশ্যই উন্নত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এই হাসপাতালের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই। হাসপাতাল মানে শুধু রোগী আর ডাক্তার নয়, হাসপাতালের পরিবেশ, বসার ব্যবস্থা, কমিটির কার্যক্রম, ঔষধের পর্যাপ্ততা, প্যাথলজি, ফার্মাসি সকল কিছু মিলিয়েই হাসপাতাল। এই সকল কিছুর উন্নয়নের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কাজ করার আহবান জানান তিনি। পাশাপাশি সেবাগ্রহীতাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তাদের প্রত্যাশা-অনুভূতি জেনে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেটি পূরণের মাধ্যমে সেবার মান উন্নয়নের প্রস্তাবনা রাখেন তিনি। মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর নানান সীমাবদ্ধতা, জরাজীর্ণ ভবন, চিকিৎসকদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত কক্ষ ও সুযোগ সুবিধা না থাকা সত্তে¡ও এলাকার সেবাগ্রহীতাদের নিয়মিত সেবাদানের জন্য তিনি তার বক্তব্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
মুক্ত আলোচনায় মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সদস্য ও কার্বারী ভৌমিকা ত্রিপুরা জানান, মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে মেশিন আছে, কিন্তু মেশিন চালানোর লোক নেই। তাই এক্স-রে করতে হলে রোগীকে খাগড়াছড়িতে নিয়ে যেতে হয়। ফলে চিকিৎসা খরচ বেড়ে যায়। এছাড়াও একটু সিরিয়াস রোগী আসলেই এখান থেকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করা দেয়। নরমাল ডেলিভারি এখানে হলেও সিজার রোগীদের খাগড়াছড়িতেই পাঠানো হয়। তবে প্রয়োজনে সবসময় এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় বলে তিনি জানান।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা একজন সেবাগ্রহীতা মুনমুন জানান, হাসপাতালে কোন দক্ষ নার্স নেই। স্যাকমোরাই বেশিরভাগ সময় চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। তাছাড়া তিনি হাসপাতালের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভারের কথাও উল্লেখ করেন।
সহকারি স্বাস্থ্য পরিদর্শক বিবেকাময় রোয়াজা মুক্ত আলোচনায় কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন সেবাসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত উপস্থাপন করেন। তিনি জানান কমিউনিটি ক্লিনিকে যক্ষা, ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা ও চিকিৎসা সবকিছুই করা হয়। এছাড়া ক্লিনিকে ৩২ প্রকার প্রয়োজনীয় ঔষধ আছে, সেবাদানের জন্য স্বাস্থ্য কর্মীরা রয়েছেন। ১০ টা মারাত্মক রোগের প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে। সবকিছুই প্রদান করা হচ্ছে বিনামূল্যে। তাই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবাগ্রহন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন এবং কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অফিস চলাকালীন সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীকে না পেলে ফোন দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানোর অনুরোধ জানান।
মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর মেডিকেল অফিসার ডা. কলিন্স চাকমা জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ এক্স-রে মেশিন আছে, রেডিওলজিস্ট বর্তমানে বিএসসি ট্রেনিং-এ আছেন। তাই অপারেটর না থাকায় এক্স-রে করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ইউরিন, ডেঙ্গুসহ সকল পরীক্ষা নিয়মিত করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সর্বমোট ৯৪ জন লোকবল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে ৫৬জন রয়েছে বলে তিনি জানান। ৭ জন মেডিক্যাল অফিসারের মধ্যে ২জন খাগড়াছড়িতে সদর হাসপাতালে দায়িত্বরত আছেন এবং হাসপাতালে ডিউটি হচ্ছে ৩ শিফটে। হাসপাতালে কোন কৈশোর বান্ধব কর্ণার নেই। পর্যাপ্ত নার্স-এর সংকট রয়েছে এবং মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট রয়েছেন ১ জন। তিনি আরও জানান, ডাক্তারের বসার রুমের খুবই বেহাল অবস্থা, বৃষ্টি হলে পানি পড়ে, একরুমে ২ জন ডাক্তার, মহিলা রোগীদের দেখার জন্য কোন রুম নেই, কোন প্রাইভেসি নেই। এই সকল সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সভাপতি শাহজাহান পাটোয়ারী বলেন, একসময় মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবার মান খুবই ভাল ছিলো। পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার ছিলো এখানে, আর ডাক্তাররাও ছিলেন খুবই আন্তরিক ও নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসকরা এখানে থাকতে চান না। দীর্ঘদিন ধরে এক্স-রে মেশিন চালানোর অপারেটর নেই, অধিকাংশ টেস্ট করতে হয় বাইরে, তাই এলাকার লোকজন হাসপাতালে না এসে গ্রামের হাঁতুড়ে ডাক্তারদের কাছেই যাচ্ছে চিকিৎসা নিতে। রোগী একদম সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছালেই শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। তখন নানান সীমাবদ্ধতার কারণে আর এখানে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হয় না। তাই তিনি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহনের জন্য, দ্রুত শূণ্য পদসমূহ পূরণের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান এবং এই পেশাকে সেবা হিসেবে গ্রহনের আহ্বান জানান।
প্রতিবেদক: জয় প্রকাশ ত্রিপুরা,কো-ফোকাল, স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম,জাবারাং কল্যাণ সমিতি, খাগড়াছড়ি।
Citizen's Voice